তথাস্তুঃ চতুর্থ পর্ব। রঙ্গন রায়।
গোসানীমঙ্গল কাব্য অবলম্বনে
রঙ্গন রায়
চতুর্থ পর্ব
আগে যা হয়েছিল : চণ্ডীর আশির্বাদে অঙ্গনা গর্ভবতী হ'ল। এই অবস্থায় একদিন সে স্বপ্ন দেখল। অদ্ভুত এক স্বপ্ন। কতগুলি সাপ ফণা তুলে তার মাথার চারপাশে ছায়াদান করছে। অবশেষে এক শুভদিনে পুত্র সন্তান প্রসব করল অঙ্গনা। তারপর ...
জামবাড়ী গ্রাম, প্রাগজ্যোতিষপুরের পশ্চিমভাগ
পাঁচ বৎসরের বাচ্চাটি যখন দৌঁড়োয়, বাতাসে ওর কৃষ্ণ কেশ সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় কম্পিত হয়। দৃকপাত করলেই, আনন্দে ভরে ওঠে বুক। এমন রূপবান শিশু বড় একটা নজরে পড়ে না। যেন দেবশিশু। জামবাড়ী গাঁয়ের পণ্ডিতবর্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মঙ্গল আচার্যও ওকে দেখলেই বিস্ময় বোধ করেন। চেয়ে চেয়ে ওর অবিন্যস্ত চুলের দিকে তাকিয়ে ভাবেন, অতটুকু মাথায় কত ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক, তার এত স্তম্ভিত করা ক্ষমতা!
মঙ্গল আচার্য নিজস্ব পর্ণকুটিরের দাওয়ায় বসে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন আর আমোদিত হচ্ছিলেন। তিনি মুনি। মননশীল চিন্তা তাঁর কাজ। জ্ঞান বা মননচর্চায় জীবন অতিবাহিত করতে গিয়ে ঢের ছাত্র পেয়েছেন। তার মধ্যে বহু ছাত্রই কৃতি। তাদের কৃতিত্বই তাঁর প্রকৃত গুরুদক্ষিণা। কিন্তু এই ছেলেটি যেন সবাইকে ছাপিয়ে যাবে।
মনে আছে, প্রথম যেদিন তাঁর এই গুরুগৃহে বিদ্যার্জনের জন্য পিতার হাত ধরে সে এল, সেদিনই ওর ললাটে লক্ষ করেছিলেন রাজতিলক। অনুভব করেছিলেন এ সাধারণ শিশু নয়। ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিভা রয়েছে। পরদিন প্রত্যূষেই সূর্য প্রণাম মন্ত্র একবার শুনেই মুখস্থ বলে দিয়েছিল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এই দীর্ঘ ত্রিশ বৎসরের শিক্ষকতার জীবনে এমন ঘটনা আগে কখনও হয়নি।
বয়স সবেমাত্র পাঁচ, এখনও শিশুই, অথচ এরই মধ্যে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা শিখে ফেলেছে। মঙ্গল আচার্যও ভীষণ যত্ন নিয়ে তাকে শেখাচ্ছেন। কিছু কিছু ছাত্রকে পড়িয়ে অদ্ভুত আনন্দ হয়। ব্যাকরণ ও কাব্য শাস্ত্রও রীতিমতো রপ্ত করে ফেলেছে সে। ছেলেটির মেধা তাঁকে আশা যোগাচ্ছে।
শুনেছিলেন, অনেক যুগ আগে কপিলাবস্তু রাজ্যের রাজপুত্র গৌতম ছিল অপরিসীম মেধাবী। তবে সে সব কিছু ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছিল। এতদঞ্চলেও ওঁর মতানুগামীদের বেশ কিছু স্তুপ ও বিহার রয়েছে। নিজস্ব ধর্মমত তৈরি করেছিল সে। রাজা হয়নি। হয়েছিল সন্ন্যাসী। এই ছেলেটির চক্ষুদ্বয়ে অবশ্য ত্যাগযোগ নেই। ভোগ রয়েছে। সে রাজা হবে। ঐশ্বর্যের প্রতি বিরাগ কখনও জন্মাবে না। বরং রাজ্যটিকে ঐশ্বর্যের অতুল শোভায় ভরিয়ে দেবে।
মঙ্গল আচার্য দাওয়াতে বসেই এবার প্রিয় ছাত্রের সামান্য পরীক্ষা নিতে চাইলেন। আর কিছুদিন পাঠ করলেই ওর শিক্ষার একটি ধাপ পূর্ণ হবে। একটি নতুন বিষয়ে পড়ানো শুরু করবেন ভেবেছেন তিনি। ও প্রস্তুত কি না সেটি গ্রহণে, তা জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
"কান্তনাথ, বাবা এদিকে একবার শোন!"
বৈকালের নরম রোদে কুটির ও অরণ্যের মধ্যবর্তী সামান্য জমিতে আশ্রমিক অন্যান্য সহপাঠীদের সঙ্গে খেলছিল সে। সারা গা হাত পায়ে মাটি লেগে আছে তার। ঐ অবস্থাতেই ছুটে এল। স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য বজায় রেখে আচার্যের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
"আজ্ঞে, গুরু মশাই বলুন।"
উপবীতটিকে আঙুল দিয়ে সামান্য ঠিক করলেন আচার্য, "মনের বাসনাকে ব্যক্ত করবার অন্যতম মাধ্যমটি কী তুমি জানো?"
"আজ্ঞে জানি গুরুদেব। শব্দ।"
"আর মনের কোনো সংকল্পকে বাহ্যিক ভাবে রূপায়ণ করবার মাধ্যমকে কী বলে?"
একটু ইতস্তত করে কান্তনাথ জবাব দিল, "মন্ত্র।"
খুশিতে চোখে দ্যুতি খেলে গেল আচার্যের। আহা! কে বলবে ওর বয়স মাত্র পাঁচ! কেমন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতের মতো ওর জ্ঞান। এবং যে দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিচ্ছে, বোঝাই যায় তাতে, না জেনে এমন উত্তর কেউ দিতে পারে না। বাচনভঙ্গি থেকেও জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
"বেশ। তাহলে তন্ত্র কাকে বলে?"
এবার নীরব রইল সে। কান্তনাথ জানে, সাধারণ সময়ে কথা বলতে গেলে গুরু মশাই 'তুই' সম্বোধনে কথা বললেও পড়ানোর সময় সবসময় 'তুমি' সম্বোধনে কথা বলেন। কিন্তু এসব কী প্রশ্ন করছেন তিনি? এগুলো তো তাকে এখনও পড়ানোই হয়নি!
ছাত্রকে নিরুত্তর দেখে সামান্য হাসলেন আচার্য। উত্তর না দিতে পারা স্বাভাবিক। তাঁর সংস্কার বলে, প্রতিটি ছাত্রের ভেতর জ্ঞানের ছায়া থাকে, কোনও না কোনও পূর্বপুরুষের জাতক হয়ে। ভক্তীশ্বরের সন্তান কান্তনাথ। সুতরাং যেটুকু না পড়ানোতেই পেরেছে, তা'ই যথেষ্ট।
"আজ্ঞে এ বিষয়ে আপনি আমাকে ইতোপূর্বে পাঠ দেননি।"
স্নেহের দৃষ্টিতে তাকালেন মঙ্গল আচার্য। প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে যে ছাত্রের অস্বস্তি হয়, তার জ্ঞানপিপাসা অসীম থাকে। দাওয়া থেকে নেমে এসে তিনি কান্তনাথের চুলে আঙুল বুলিয়ে দিলেন। বললেন, "মন্ত্রের সঙ্গে প্রকৃতিজাত বস্তু, প্রাণী বা গাছের সন্নিবেশ করে যে সংকল্প রচনা করা হয় তাকে তন্ত্র বলে। তোমাকে এখনও এর পাঠ দিইনি। তবে শীঘ্রই দেব। আগামী সপ্তাহ থেকেই শুরু হবে তোমার তন্ত্রমন্ত্রের শিক্ষা। তারপর রাজনীতি বিজ্ঞান।"
কান্তনাথের ভেতর তেমন ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না। জ্ঞান লাভের আনন্দকে সে গোপন করতে জানে। এই গোপনীয়তা লোভকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। আচার্য তাকে পুণরায় খেলতে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
কান্তনাথ চলে গেলে পর, পরণের কাপড় ঠিক করে গৃহের পশ্চাতে অরণ্যের নিকটবর্তী পুকুরের ধারে বেঁধে রাখা গাভী দুটিকে আনতে উদ্যত হলেন তিনি। মনটি বড় প্রফুল্ল হয়ে আছে। প্রকৃত অর্থে কান্তনাথই যেন তাঁর মন্ত্র। আসলে একেকটি ছাত্র একেক সময়ে আচার্যের নিকট মন্ত্র হিসেবে ধরা দেয়। আধ্যাত্মিক অর্থে মনের ত্রাণ বা মুক্তিকে মন্ত্র বলা হয়েছে। এখন এই প্রিয় ছাত্রটিই আচার্যের মনের ত্রাণ, মনের মুক্তি। জ্ঞান দানের সঠিক আধার।
পশ্চিম আকাশ থেকে বিস্ফোরণের ন্যায় গোধূলি ছড়াচ্ছে সমগ্র চরাচরে। ঘরে ফেরা পাখিদের কলরবে বাতাস মুখরিত। ওপাশে ক্রিড়ারত বালকেরা অদ্যকালের অন্তিম খেলার কোলাহলে ভরিয়ে তুলেছে মাঠঘাট। কান্তনাথ ছুটে ছুটে যাচ্ছে অরণ্যের দিকে। এত গুলি শিশুর মধ্যে সে দলনেতা। ঘরের পথে ফেরা কাকেরা তীব্র ডাকাডাকি করে যেন সম্মান জানাচ্ছে তাকে। গৌরবর্ণ নগ্ন শরীরে গোধূলি পতিত হওয়ার ফলে দেবশিশু বলে ভ্রম হতেই পারে, কিন্তু কান্তনাথ শুধুই দেবশিশু নয়। ঈষৎ ভেজা উপল খণ্ডটির উপর ডান পা তুলে, পাঁচ বছর বয়সী দেহটি যে ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে, তাতে তাকে রাজকুমার ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যাবে না।
(চলবে)
Comments
Post a Comment