ছবিতে নারী এবং নারীর ছবি। নবম পর্বঃ শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়

 

 

ছবিতে নারী এবং নারীর ছবি

শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়

 

নয়

 

কুড়ি বছরের একটা প্যাচ অফ টাইম কিন্তু আঁকার ইতিহাসে নিজ গুনে সে সময় ভাস্বর ইউরোপীয় পপুলার আর্ট কালচারে। আর্ট ন্যুভ।  অর্থাৎ কি না  নতুন আঁকার দিকগুলোকে নিয়ে একটা ব্যতিক্রমী ভাবনার অবকাশকে উসকে দেওয়ার সময় এ কুড়ি বছর। ১৮৯০ হতে ১৯১০।  ইউরোপীয় আর্টে আর্ট ন্যুভকে সামনে নিয়ে এসেছেন গুস্তাভ ক্লিম্ট। এছাড়া মুচা অথবা ইগন শেলয়্যার কাজের মধ্য দিয়ে যে ডেকোরেটিভ কল্পরাজ্য ধরা পড়ে তা আর্ট ন্যুভর মূল প্রতিপাদ্য৷ লত্রেকও এই  সময় কালার এসেন্সের  আউটলুককে স্বীকৃতি দিয়েছেন আর্ট ন্যুভতে। গুস্তাভ এর কাজে যে ফ্লোরাল আলংকারিক ভাবনার উন্মেষ ঘটেছে তা একটা উত্তরণের অথবা একটা সন্ধিক্ষণের ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। আকাদেমিক আর্টের থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা নিয়ে একটা ডায়নামিকস স্টাইলাইজেশনকে প্রমোট করতে চেয়েছিল আর্ট ন্যুভ। আর্ট ন্যুভর ক্ষেত্রে হুইপল্যাশ  লাইন বলে একটা কথা প্রচলিত। যা ডেকোরেটিভ মোটিভ ডিজাইনের একটি উপজীব্য বিষয়। আর মজাটা হচ্ছে এই হুইপল্যাসের উৎপত্তি কিন্তু ইসলামিক আর্ট। খুঁজতে গেলে এর উৎপত্তি পাওয়া যায় রোকোকো স্টাইলেও আবার আরও প্রাচীন মধ্য এশিয়ার সমরখন্দ অথবা  জাপানি মোটিভেও  আর পাওয়া যায়। আর্ট ন্যুভর পথচলার তাই একটা নির্দিষ্ট ইতিহাস রয়েছে। আসলে এই সময়ের ইউরোপীয় ছবি বেশি করে মধ্যপ্রাচ্য ও সুদূরপ্রাচ্যের দিকে ঝুঁকে ছিল। আর এইভাবে প্রথম আর্ট ন্যুভ ছবি ও স্থাপত্যের মাঝে দূরত্ব কে এক ফ্রেমের মাঝে  ধরেছিল। যা পরবর্তীতে ইনস্টলেশন আর্টকেও অনেকটা মুক্তির খোঁজ দিয়ে গেছে।

আর্ট ন্যুভতে যে সকল মেয়েরা অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে আজ  আসুন পাঠিকা পরিচিত হই বারো জন চিত্রীর সঙ্গে-

এলিস রাসেল গ্লিনি (১৮৫৮-১৯২৪) -   আমেরিকান চিত্রী গ্লিনি ছিলেন বাফেলো সোসাইটি অফ আর্টিস্টের সভাপতি। তাঁর করা পত্রিকার অলংকরণ গুলো আর্ট ন্যুভর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ছবিতে প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতি টানটা ধরা পড়ে সুস্পষ্ট। জাপানের উডব্লক পেইন্টিং গুলো দ্বারা গ্লিনি ছিলেন বিশেষভাবে প্রভাবিত। গ্রাফিক ডিজাইনে তাঁর অবদান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা  এলিসের উপস্থিতি এখনো ভাস্বর করে রেখেছে ছবির দুনিয়ায়।

মারগারেট ম্যাকডোনাল্ড (১৮৬৪-১৯৩৩) -  গ্লাসকো স্টাইলের অন্যতম সদস্য মার্গারেট প্রভাবিত ছিলেন বাইবেল ও গ্রিক সাহিত্য দ্বারা। তাঁর সিম্বলিক নেচার তাঁকে যথেষ্ট স্টাইলিশ করে তুলেছিল। দ্য মে কুইন, হোয়াইট রোজ এন্ড রেড রোজ, অপেরা অফ দ্য উইন্ড তাঁ আঁকা বিখ্যাত ছবি। এছাড়া তাঁর আঁকা ওফেলিয়া সিম্বলিজমের এক অনবদ্য সংমিশ্রণ যা ভাবনাকে নতুন মাত্রা প্রদান করার পাশাপাশি মিল্লাসের ওফেলিয়ার পাশে মারগারেটের ওফেলিয়াকে বসিয়ে দুটো ছবিকে নতুনভাবে চিনতে সাহায্য করে। (ছবি - ৩৩)  

ছবি ৩৩

এলিজাবেথ সোনরেল (১৮৭৪-১৯৫৩) -  ফ্রেঞ্চ চিত্রী সোনরেল একটা রহস্যময়তা সৃষ্টিতে সার্থক ছিলেন ছবিতে। সোমরেলের ছবির মেয়েরা তার মুখগুলো ডেকোরেটিভ নেচারের পেছনে যে অভিব্যক্তিগুলো ধরে রয়েছে তা তাঁর ছবিকে অনেক বেশি জীবন্ত করে তোলে। প্রতিকৃতির প্রতিটি নারী হয়ে ওঠে সময়ের ভাষ্য। তার ১৯০০ সালে করা এক্সিবিশনটি ছিল আর্ট ন্যুভর ভাবনা দ্বারা পরিচালিত।

জুলি ডি গরাগ (১৮৭৭-১৯২৪) -  তীক্ষ্ণ লাইন এনগ্রাভিং এর কাজ গুলো জুলির আর্ট ন্যুভকে প্রতিনিধিত্ব করে। ডাচ চিত্রী রয়েল একাডেমি অফ ফাইন আর্টস এ পড়াশোনা করেন। তাঁর আর্ট ন্যুভর কাজগুলোর প্রিন্টমেকিং এর অন্যতম উপজীব্য।

জেরডা ওয়েগনার (১৮৮৬-১৯৪০) -  ডেনিস  ইলাস্ট্রেটর ও চিত্রী  ওয়েগনার ছিলেন ক্যুয়র আর্ট জনারের অন্যতম মুখ। আর্ট ন্যুভকেও নতুন মাত্রা প্রদান করেন। নারী শরীর ও তার নানান রাজনীতি যেভাবে ওয়েগনারের ছবিতে চিত্রিত হয়েছে তা ক্যুয়র আর্ট ফ্রম কে সাহস যোগায় বৈ কি! (ছবি - ৩৪)

 

ছবি ৩৪

 

জেসি এম কিং (১৮৭৫-১৯৪৯) -  স্কটিশ চিত্রী তার অলংকরণ করা বই গুলোর মধ্য দিয়ে আর্ট ন্যুভকে তুলে ধরেছেন। তাঁর কাজগুলো বত্তিচেল্লির কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত। কিং এর ছবিগুলো দেখলে ডেকোরেটিভ ছবির যে লাইনগুলো পাওয়া যায় তা তাঁর সুচারু মননের বহিঃপ্রকাশ বলে ধরা হয়। সেখানে অনুপ্রেরণা যেমন আছে তেমনি আছে আগামী দিনের পথ চলার একটা প্রয়াস।

গোয়েন জন (১৮৭৬-১৯৩৯) -  আর্ট ন্যুভ কিভাবে উত্তর অন্তরমুদ্রাবাদকে প্রভাবিত করেছিল তার সঠিক নিরূপণের জন্য গোয়েনের ছবি দেখতে হয়। ফ্রান্সের এই চিত্রী এঁকেছেন মূলত প্রতিকৃতি ও স্থিরচিত্র। এ সংক্রান্ত বিষয়ে পাঠিকা পড়ে দেখতে পারেন জন ম্যাকক্লমের উপন্যাস 'দ্য  গোয়েন জন স্কাল্পচার'।

ইভা ফ্রান্সিস (১৮৮৭-১৯২৪) -  আমেরিকান চিত্রী ইভা মূলত ছবি করেছেন বোটানিকাল ও ফ্লোরাল প্রিন্টে। এই ডিজাইনগুলো আর্ট ন্যুভর অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ।

ভ্যানেসা বেল (১৮৭৯-১৯৬১) -  ভার্জিনিয়া উলফের বোন ভ্যানেসা ছিলেন ব্লুমসবেরি গ্রুপের অন্যতম সদস্যা। ভ্যানেসার উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো 'দ্য টব', 'ইন্টেরিয়ার উইথ টু ওম্যান', 'আইসল্যান্ড পপিস'। এছাড়া ভার্জিনিয়ার বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন ভ্যানেসা।

এথেল রাইট (১৮৬৬-১৯৩৯) -  ব্রিটিশ চিত্রী রাইট ছিলেন সমকালীন শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন প্রদর্শনীতে রাইটের ছবি প্রদর্শিত হয় যার মধ্যে তাঁর আঁকা প্রতিকৃতির কাজ গুলো অন্যতম।

সুসান হিনকলি ব্রাডলি (১৮৫১-১৯২৯) -  আমেরিকান চিত্রী তাঁর ছবির মধ্যে যে অরনামেন্টেশন রচনা করেছিলেন তাতে অরিয়েন্টাল আর্ট এর প্রতি তার যে  ঝোঁক তা ধরা পড়ে সুস্পষ্ট।

ওয়ান্ডা গ্যাগ (১৮৯৩-১৯৪৬) -  গ্যাগে কাজগুলো মূলত বইয়ের প্রচ্ছদকে কেন্দ্র করে। তার আঁকা বাচ্চাদের বই 'মিলিয়নস অফ ক্যাটস' আমেরিকার প্রাচীন ছবির বইগুলোর একটা। 'ইভিনিং' ছবিটির কথা আলাদা করে বলতেই হয় যেখানে আলোছায়া একদিকে যেমন ডেকোরেটিভ আর্টের ঐতিহ্য তুলে ধরেছে তেমনি অন্যদিকে ছবিটি হাত বাড়িয়েছে ইম্প্রেশনিজমের দিকে অর্থাৎ একটা যুগসন্ধির সাক্ষী থেকেছে গ্যাগ ও তাঁর ছবিগুলো। (ছবি- ৩৫) 

ছবি - ৩৫

ইউরোপীয় আমেরিকান চিত্রীদের ছবি কিন্তু এই সময় যথেষ্ট পরিমাণে অরিয়েন্টাল আর্ট ফর্মের দ্বারা প্রভাবিত। জাপানের ছবির প্রতি অনুরক্ত হয়ে এই সময় জাপানিজম সামনে উঠে আসছে। জাপানে এ সময় চিত্রী হিসাবে শিরোনামে আমরা পাচ্ছি ওকুহার সেইকো (১৮৩৭-১৯১৩)। ১৯০৭ সালে ওকুহার আঁকেন 'বিউটি বাই পাম এবং উইন্ডো'। তাঁর ছবিতে চৈনিক ছবির ক্যালিগ্রাফি ও রঙের প্রভাব স্পষ্ট। জাপানিজমের পাশাপাশি এই সময় চৈনিক শিল্পরীতিতেও এসেছে কিছু পরিবর্তন। চীনে এই সময় যেমন কাজ হচ্ছে ল্যান্ডস্কেপের, তেমনি কাজ হচ্ছে উড কাট এনগ্রেভিং ও ক্যালিগ্রাফিতেও। চৈনিক মহিলা চিত্রী হিসেবে উঠে আসেন এই সময় শেন শাউ ( ১৮৭৪ -১৯২১)। তিনি ছিলেন চৈনিক এমব্রয়ডারী চিত্রী। চীনের কুইং যুগের শেষে ও রিপাবলিকান যুগের প্রথমার্ধে তিনি কাজ করেছেন। তার আর্টিস্টিক এমব্রয়ডারি স্টাইলের দ্বারা সে সময় অনেকেই প্রভাবিত হন। ১৯১১ সালে তিনি মেয়েদের হস্তশিল্প শেখার স্কুল নির্মাণ করেন। তাঁর কাজের ধরনকে 'লাইভ লাইক এমব্রয়ডারী' বলে শনাক্ত করা হয়। তাঁর যীশুর প্রতিকৃতিটি  'সেজ অব এমব্রয়ডারির' একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। যা ১৯১৫ সালে নতুন করে পশ্চিমী দুনিয়ার নজরে আসে। (ছবি - ৩৬)

ছবি - ৩৬

ভারতে সে সময় কাজ করছিলেন প্রতিমা দেবী (১৮৯৩-১৯৬৯)।  অর্থাৎ কিনা শুরু হচ্ছে ঠাকুরবাড়ি প্রভাব। অরিয়ান্টাল স্কুলের পথ চলা। প্রতিমা দেবী শিখেছিলেন ইটালিয়ান ওয়েট ফ্রেস্কো মেথডে ছবি আঁকা। বাকি ভারতে তখন রাজা রবি বর্মার প্রভাব। অর্থাৎ ভিক্টোরিয়ান রীতি ভারতকে তখনও প্রভাবিত করে চলেছে। এর পাশাপাশি আছে ভারতীয় দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করে চলার একটা তাগিদ। ফলত আর্য ও অনার্য আর্টের দুটো স্বতন্ত্র পথ চলা লক্ষ্য করা যায় ভারতে।

আর্ট  ন্যুভ ইউরোপ-আমেরিকায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক প্রাক্কালে ভাবনার লালিত্যকে প্রকাশ করতে সার্থক হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ এসে সেখানে থাবা বসালো। ভেঙে ছুটে গেল সে পথ চলা। ছবির ভাবনারা নতুন মাত্রা পেতে শুরু করলো। ছবিতে বাস্তবের পাশাপাশি কল্পনা, কল্পনার পাশাপাশি অভিব্যক্তি পথ চলা শুরু করল। ধীরে ধীরে আর্ট ন্যুভ ছবির ভাবনার পরিসর হতে বেরিয়ে আসতে থাকলো। আর্ট ন্যুভ তবে কি ছিল! কি দিল? সে দিয়েছে স্পেসের ব্যবহারে বৈচিত্রতা। ডিজাইনের সিমেট্রি ও এসিমেট্রির মিশেল। আর অতি অবশ্যই ইনস্টলেশন আর্টকে নতুন এক দিশা।  (ক্রমশ)

 

সূচীপত্রে যাওয়ার সূত্র 

Comments

Popular posts from this blog

টাউন বাজারৎঃ বাজার বেদনা। নিঝুম ঠাকুর

সান্ধ্য জলপাইগুড়ি ১১ জুন, ২০২২ঃ সূচীপত্র