টাউন বাজারৎঃ বাজার বেদনা। নিঝুম ঠাকুর
বাজার বেদনা
নিঝুম ঠাকুর
বাজারে পাকড়াশিবাবুর সাথে দেখা হলেই বলবেন, ‘চলুন ভূতুমবাবু চা খাওয়া যাক।’
গত শনিবার চার তারিখ জামাই ষষ্ঠীর আগের দিন স্টেশন বাজারে পাকড়াশিবাবুর সঙ্গে দেখা।বড় ম্লান স্বরে বললেন, ‘এই যে ভূতুমবাবু বাজারে কখন এলেন? চলুন এক কাপ করে চা খাওয়া যাক।’
যথারীতি চায়ের দোকানে ঢুকে পাকড়াশিবাবু দু কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন। এখানেও কথার মধ্যে জোর ছিল না।
চা এসে গিয়েছিল, চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাপার কী পাকড়াশিবাবু? আজকে বড় ম্লান লাগছে আপনাকে!’
‘আর কী বলব আপনাকে,গিন্নি পুরো রোলার চালিয়ে দিয়েছে ভূতুমবাবু। আজকে দুই মেয়ে আসছে আর দুই জামাই আর তাদের ছানা-পোনারা।’
আমি বললাম, ‘সে কি! মেয়ে-জামাই আর নাতি-নাতনিরা জামাইষষ্ঠীতে আসবে তাতে তো আপনার আনন্দ হওয়ার কথা, তাতে আপনি কেন মুষড়ে পড়ছেন?’
পাকড়াশিবাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘কী আর বলব ভূতুমবাবু! আনন্দ তো হওয়ারি কথা, কিন্তু গিন্নি বাজারের যে ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছে তাতে আমার মাথা বন্ বন্ করে ঘুরছে। ইলিশমাছ নিতে হবে তিন কেজি। গিন্নি সাদা কাগজে ইলিশমাছের ছবি এঁকে দিয়েছে, আর কত বড় বড় পিস হবে তাও এঁকে দিয়েছে সেই অনুযায়ী পিস করে নিতে হবে। মাছ বাজারে একবার ঢুঁ মেরে এসেছি। কেজি খানেকের ষোলো শো আর এক কেজির ওপরে দু হাজার টাকা কেজি! দুই জামাইকে গিন্নি ইলিশের বড় বড় টুকরো খাওয়াবে। শুধু কি তাই? বড় সাইজের কাতলা নিতে হবে কেজি দুয়েক।চারশো টাকা কেজি। ছোট মাছও নিতে হবে কম পক্ষে কেজি খানেক।টাটকা ছোট দেশি ট্যাংরা দেখলাম দুশো টাকা পোয়া। তিন কেজি ষোলোশোর ইলিশ নিলে তিন ষোলোং আটচল্লিশশো, দুই কেজি কাতলা নিলে চার দু গুণে আটশো টাকা।এক কেজি ছোট দেশি ট্যাংরা নিলে আটশো টাকা।সবমিলিয়ে প্রায় সাড়ে ছ হাজার টাকা! তারপরে আছে লিচু, আম আর কয়েক রকমের মিষ্টি। পকেটে আছে সাত হাজার টাকা! থাকবেও ওরা কয়েক দিন। এ কদিনের খরচ কী করে যে সামাল দেব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা! সব জিনিসের দাম হু হু করে যেভাবে বাড়ছে সে তুলনায় পেনশনের টাকা তো বাড়ছেই না এদিকে সুদও কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে আসল টাকায় হাত পড়ে যাচ্ছে।আসল টাকাও কমে যাচ্ছে। আগামী দিনে কী যে আছে কপালে কে জানে!’
আমি পাকড়াশিবাবুকে কখনও এভাবে ভেঙে পড়তে দেখিনি।ওনার শেষের কথাগুলো খুব সত্যি।
শুধু পাকড়াশিবাবু কেন, আমি, আমার মতো অনেক চাকুরেদেরই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এই বাজারে। আর সাধারণ লোকের কথা তো কহতব্য নয়। তবুও পাকড়াশিবাবুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, ‘দেখুন পাকড়াশিবাবু, যা হবার তা হবেই তা আপনি আমি আটকাতে পারবো না। এখান থেকেই যে ভাবে হোক চালাতে হবে। আর দেখুন মেয়ে এসেছে, জামাই নাতি-নাতনিরা এসেছে। আপনার কষ্ট হলেও আনন্দিত হওয়া উচিত।’
পাকড়াশিবাবু আমার কথা শুনে বললেন, ‘দেখুন ভূতুমবাবু, মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনিরা এসেছে বেশ কিছুদিন পর। এতে আমি খুবই আনন্দিত। শুধু গিন্নি যদি বাজারের ব্যাপারটা বুঝতো তবে ভালো লাগতো। দুদিন আগে টিভিতে জামাই ষষ্ঠীর বিজ্ঞাপন দেখেছে --- জামাইকে শ্বাশুড়ি কত বড় বড় ইলিশ মাছের কত রকমের পদ রান্না করে খাওয়াচ্ছে। তার সাথে কাতলামাছ আর ট্যাংরা মাছের টিভিয়ান পদ। টিভিতে যা যা বলেছে ঠিক তাই কপি করেছে। এই দেখনদারিটাই আমাকে কষ্ট দিয়েছে।বিজ্ঞাপনকে বাস্তবে পরিণত করে জামাইকে রসিয়ে রসিয়ে খাওয়াতে গিয়ে আমার পাজামার রশিটা যে খুলে যাচ্ছে সেটা বোঝে কে?’
Comments
Post a Comment