সম্পাদকীয়ঃ মধুবালার বেড়াল
মধুবালার বেড়াল
বিজয় দে প্রণীত সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘সমগ্র মধুবালা কেবিন’-এর প্রথম কবিতা শুরু হচ্ছে এভাবেঃ
যত বাক্য লেখা হ’ল, শেষ পর্যন্ত সব যেন একহারা পেঁপেগাছ
কিম্বা আত্মহারা বেড়াল-পাড়া
স্পষ্ট একটি উপমা। ‘বাক্য’ তুলনীয় একহারা পেঁপেগাছের সাথে। অবশ্য কবি ঠিক নিশ্চিত নন। তিনি ‘যেন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্র এই সংশয়কে অনুমোদন দেয়, কিন্তু অভিনবগুপ্ত যদি এই উপমার বিচার করতে বসতেন তবে সমস্যায় পড়ে যেতেন। কারণ, উপমান (যার সাথে তুলনা) এবং উপমেয় (যাকে তুলনা করা হচ্ছে) --- এই দুই-এর মধ্যে এমন একটি সাধারণ ধর্ম থাকবে যার ভিত্তিতে তুলনা সম্বব। যেমন ‘চাঁদমুখ’ হলো চাঁদের সাথে মুখের তুলনা এবং এই তুলনার ভিত্তি হলো ‘সৌন্দর্য’। মুখটা চাঁদের মতই সুন্দর। চন্দ্র এবং মুখ --- এই দুই-এর মধ্যে কমন ব্যাপারটা হলো ‘সৌন্দর্য’। সেটাই সাধারণ ধর্ম। কিন্তু ‘বাক্য’ এবং ‘একহারা পেঁপেগাছ’-এর মধ্যে তুলনা করা হয়েছে কোন ধর্মের ভিত্তিতে? বাক্য কি একহারা পেঁপেগাছের মত ‘সোজা’? ‘সরল’? ‘ঋজু’?
পরের লাইনে আবার এসেছে ‘আত্মহারা বিড়াল-পাড়া’। এর সাথে ‘বাক্য’ কোন সাধারণ ধর্মের ভিত্তিতে তুলনীয়? প্রাচীন কবিরা উপমা ব্যবহার করতেন বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। কিন্তু আধুনিক কবিতায় উপমা আসে কবির মনের গভীর অনুভব থেকে। অভিনবগুপ্ত রসিক ছিলেন। তিনি অন্ততঃ বুঝতে পারতেন যে ‘বাক্য’ উপমেয় হলেও এর অন্ততঃ দুটি বস্তুর সাথে এর তুলনা হয়েছে। তিনি এটাকে ‘মালোপমা’ বলে স্বীকার করতেই পারতেন। কিন্তু কোন সাধারণ ধর্মে ‘একহারা পেঁপেগাছ’ আর ‘আত্মহারা বিড়াল-পাড়া’ মিলে যায়?
না। এই প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর নেই কারণ এটাই আধুনিক কবিতার রহস্যের জায়গা। কবিতাটি তো সবে শুরু হয়েছে! এরপরেই আমরা পড়বঃ ‘পাকা পেঁপের ভেতরে বেড়ালের লোম/ উড়ছে’। কেবল তাই-ই নয়। ‘অক্ষর ও বর্ণমালা সবাই নাক চেপে বসে আছে’। অভিনবগুপ্ত এবার সোজা হয়ে বসেছেন। তিনি মনে মনে বলছেন, ‘ওহে বিজয়! তুমি তো অক্ষর এবং বর্ণমালাকে মানুষ বানিয়ে ফেলেছ! আমাদের কাব্যে শুক-সারি কথা বলত। হরিণ-বাঘেরাও বলত। কিন্তু তুমি যা বললে তা অভিনব বটে! পাকা পেঁপের ভেতর বেড়ালের লোম উড়ছে --- এটা তো বাস্তবে সম্ভব নয়। তুমি নিশ্চই পেঁপে আর বেড়াল শব্দ দুটি আভিধানিক অর্থে গ্রহণ করো নি!’
কৌতূহলী অভিনবগুপ্ত আরো পড়তে লাগলেন। ‘গাছ কাটলে যদি বেড়াল বেরিয়ে পড়ে; যদি/ গাছ কাটলে বেড়াল লাফ দিয়ে নেমে আসে’। পড়তে গিয়ে তাঁর মুখে ফুটে উঠল মৃদু হাসি। যেন ঝুলির বেড়াল বেরিয়ে পড়ল। যেন ঝুলি নাড়তেই লাফ দিয়ে নেমে পড়ল বেড়াল। বইটা বন্ধ করে তিনি একটু সোমরস পান করলেন। অহো! কী অপূর্ব ব্যাঞ্জনা! বিজয়বাবু যেন কোন গুপ্ত সংবাদ জেনে গেছেন। তাঁর বেড়াল একটা সোজা কথা জানে। যেটা পেঁপেগাছের মত একহারা।
তাহলে পেঁপেগাছ আসলে কী? এটা কি রূপক? এই গাছ সোজা কিন্তু নরম। এটা কি নারীর রূপক? নারীর গুপ্তকথা জেনে ফেলেছেন বিজয়? মার্জারের নমনীয় চলন কি নারীর কথা মনে করায় না? কবিতার শেষ লাইনে বিজয় লিখেছেনঃ ‘তাই, আমি এখন কলমের মুখ বন্ধ করে দিলাম’।
অভিনবগুপ্ত চিন্তিত মনে আরো এক ঢোঁক সোমরস পান করলেন। বিজয় কলমের মুখ বন্ধ করে ফেললেন মানে আর কিছু বলতে চাইছেন না। ঝুলির বেড়ালকে তিনি বের করতে অনিচ্ছুক। তাঁর কাব্যের নামে একজন নারী রয়েছে। তাঁর নাম ‘মধুবালা’।
বেড়ালটা কি মধুবালার?
বইতে বেড়াল আবার এলো দ্বিতীয় প্রবাহের ১৯ নম্বর কবিতায়। ‘প্রেমে আছে কুকুর-বেড়াল’। আবার তাকে পেলাম তৃতীয় প্রবাহের শুরুতে। সকালে একটি বেড়াল-মা তার বাচ্চাকে নিয়ে এঘর-ওঘর ছুটে বেড়াচ্ছিল বটে, কিন্তু বিজয়বাবুর মনে হলো ‘আর আমাদের ঘরগুলিও যেন ছুটছে বেড়ালের বাচ্চাটির পেছনে’। আমি নিশ্চিত অভিনবগুপ্তের বেশ মজা লাগছে। তিনি পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আবার পেয়ে গেলেন দুটি সাংঘাতিক লাইনঃ
‘ঘুমন্ত বেড়াল। মনে হবে ঈশ্বর কারোর একটি ঘুমও বাতিল করতে রাজি নন। সব ঘুম বেড়ালের সব ঘুম ঈশ্বরের আপন’
দ্রুত পাতা উল্টিয়ে চলেন অভিনবগুপ্ত। বেড়াল নেই। কিন্তু ফিরে এলো ঠিক ঊনশেষ কবিতায়। ফিরে এলো সেই পেঁপেগাছ নিয়ে। পুষি বেড়াল চিঠি লিখতে শিখে গেছে এবং গাছটি ঠিক আগের মতই আছে। কবিতার শেষে বিজয়বাবু লিখেছেনঃ
‘ভর-দুপুরে আমি এই উঠোন-ভ্রমণে এসে, পেঁপেগাছ ও বেড়ালের
খবর নিতে নিতে শুধু মধুবালার ছায়া খুঁজে যাচ্ছি’
এইবার মৃদু হাসি ফুটে ওঠে অভিনবগুপ্তের মুখে। পুথি নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ান। আড়মোড়া ভেঙে আপন মনে বলেন, ‘বলেছিলুম না ওটা মধুবালার বেড়াল। ওটাই মধুবালা।’
এই মুহূর্তে তিনি আত্মহারা বেড়াল-পাড়া’র অর্থ যেন খুঁজে পেয়েছেন।
সকাল সকাল এমন চমৎকার সম্পাদকীয় পড়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।
ReplyDelete