টৌন জল্পেশগুড়িঃ শ্যামলে সবুজে। কদমতলা বর্মন।
সজলে শ্যামলে
কদমতলা বর্মন
পাহাড় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে জুন মাসের জল হওয়ার অপেক্ষায়। পাহাড় মানুষের ক্যালেন্ডার জানে না, শুধু জল-বাতাস চেনে। পাহাড় জানে সব বৃষ্টি ভিন্ন রকমের গান। জারুল-ঝরা নিচু পাহাড়ে মৌসুমী বায়ু এসে হাজির হয় জল-বাতাস নিয়ে। এক বছরের অনন্ত অপেক্ষার শেষে পাথরের শ্যাওলা রং ধরে। আকাশ নেমে আসে পাহাড়ের রাস্তায়। মাটির গা বেয়ে নেমে আসে নব জলধারা। পাহাড় ভেজে। ঝর্না, পাথরকে পাশ কাটিয়ে নবজল নেমে আসে নদীর শরীরে। নদীর নাম হয় খরস্রোতা। সবুজ পাহাড় ঝাপসা হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে।
বাতাসের রং সবুজ হয় না। সমুদ্রের জলকণা শুষে বাতাস পাড়ি দেয় পাহাড়ের দেশে। ভারতের গোটা ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে এসে ধাক্কা দেয় পাহাড়ের খাঁজে। এটা ভূগোল বইয়ের কথা। কিন্তু ভূগোলের বাইরেই যে অনন্ত শ্যাওলা জমে থাকে পাহাড়ের গায়ে? মৌসুমী বায়ুর জলের ছোঁয়ায় পাতায় ধরে রং শ্যাওলা বাড়ায় তার সংসার। নদীর শব্দ বৃষ্টির শব্দ একাকার হয়ে যায় রাতের বৃষ্টিতে। শুরু হয় এক অলৌকিক সঙ্গীত। ঝর্না নদী গাছ পাথর বাজাতে থাকে বাদ্য, বৃষ্টি গান হয়ে ঝরে।
মেঘ বৃষ্টি না কী মৌসুমী বাতাস পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসে পাহাড়তল বনতল সমতলে! সারা বছর সবুজ হয়ে থাকা ডুয়ার্স সমভূমি হয়ে ওঠে বৃষ্টি সবুজ। চা বাগানের কচি পাতার গায়ে জোঁকের বংশবৃদ্ধি হয় বৃষ্টিতে বাতাসে। লাটাগুড়ি আপালচাঁদ চিলাপাতা তারঘেরা জলদাপাড়ার জঙ্গলে শুরু হয় মিলন উৎসব, শুধু সমুদ্রের জল বাতাস নিয়ে একটা হাওয়া ডুয়ার্সের মাটি ছুঁলে।
সেই মৌসুমী হাওয়ায় আলাপের সুর লেগে থাকে। সে সুর বড়ই মন্থর। নাগারে বৃষ্টির শব্দ হয়ে ঝরে পড়ে বনের গায়ে পাতার গায়ে। সারারাতের মজলিশ। কখনো দ্রুত কখনো বা ঝালা হয়ে ঝরে পড়ে পরিত্যক্ত বনবাংলো অথবা টং ঘরের চালে। মৌসুমী বাতাস আর বৃষ্টি-শব্দের যুগলবন্দি শোনে ডুয়ার্সের জঙ্গলের গাছ পালা আর নির্জনতা।
তিস্তা সমভূমিতে এসে বিস্তীর্ণ হয় যেমন হয়। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা জল জমে পাট হয়ে ওঠে সবুজ। মৌসুমী বাতাসে মাথা নেড়ে দোতারার মত সুর ধরে বাতাস। তামিলনাড়ু অন্ধ্রপ্রদেশ ওড়িশা বা মধ্য ভারত হয়ে যে বাতাস জল হাওয়ায় নিয়ে হাজির হয় তিস্তা উপকূলে সে কী নিতান্ত বাদল বনের গান? সেই বাতাসের ভেতর রাজা উজিরের ভারতবর্ষের বাইরে যে লোকজীবন থেকে সেখানে যে গান থাকে সেই গান ধরে বৃষ্টির ফোঁটারা। শিরশিরে মৌসুমী হাওয়ায় একলা মানুষ গুনগুন করে লোকজীবনের গান ঝমঝম বর্ষার দিন, রাতেও।
একটা শ্যাওলা ঢাকা শহরে তিন মাস বৃষ্টি হয় মেঘ ডাকে মঞ্চের পেছনের কালো পর্দা হয়ে থাকে আকাশ। অলস এক সুর থাকে বাতাসের গায়ে। সাগরের নদীর জল ভরা মেঘ যখন বৃষ্টি হয়ে নামে শহরের অলিতে গলিতে শহরবাসী সেই বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটার সাথে নিজের নাড়ির সময়কে মিলিয়ে নেয় ঢিমেতালে। সুরের গন্ধ এখানে স্যাঁতস্যাঁতে। মানুষের বেঁচে থাকার গতি ধীর লয়ে শোনে মেঘমল্লার। শহরের ব্যস্ত রাস্তা ভিজে যায় একা, ভিড়হীন, কোলাহল বলতে তুমুল মেঘের শব্দ। বৃষ্টি বাড়লে মেঘ ডাকা কমে যায়। হাওয়ার ভেতরে থাকা সব শীতলতা ডুব দেয় স্কুল কলেজে রেনিডের প্রেয়ার লাইনের গানে। সারা শহর জুড়ে বৃষ্টি সবুজ রঙের শ্যাওলার আস্তরণ পড়ে। বৃষ্টির গানে শহরের মানুষ ঘুমায় না, জেগে থাকে না শুধু আলাপের মত ঝরে ঝরে পড়ে হাওয়ার শরীরে, বর্ষা যাপনের তিন মাস জুড়ে। যে বৃষ্টি গানের গানের অন্তরা গাওয়া হয় বাকি নয় মাস ধরে।
সারা ভারত ভূমির থেকে সঞ্চিত জল হাওয়া পাহাড়তল বনতল সমতলের মাটিতে গান হয়ে ঝরে বৃষ্টির শরীর দিয়ে।
Comments
Post a Comment