বিজয় দে-র কবিতাঃ কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য
বিজয় দে'র কবিতা
কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য
১৯৮৫ থেকে ২০২২। সেই ‘হে থুতু হে ডাকটিকিট হে অরণ্য’ থেকে শুরু করে ‘সমগ্র মধুবালা কেবিন’ পর্যন্ত স্যাম্পেন মেজাজের ১২টি কাব্যগ্রন্থ পাঠের পর এখন মনে হচ্ছে কবে আসবে ‘পাখি কোনওদিন সরলরেখা হবে না’, কবে আসবে ‘পোষ্ট অ্যান্ড ডিষ্ট্রিক্ট টমনপুর’ কিংবা আরও কিছু প্যানডেমিক মাষ্টার-পোয়েট্রি। আমরা পেয়ে যাব আরও নতুন বাংলা চ্যানেল। আমরা পেয়ে যাব আরও কিছু হাই-ভোল্টের বাংলা কবিতা ও জীবনের ন্যারেটিভ্।
তো সেই ‘সমগ্র মধুবালা কেবিন’-এ্রর কবি, ‘হে থুতু হে অরণ্য হে ডাকটিকিট’-এর কবি, ‘বোম্বে টকি’-র কবি, বিজয় দে'র কবিতায় গত চল্লিশ বছর ধরে আমি দেখি শব্দে বোনা কিছু ভার্চুয়াল ধান। কিছু মাতাল শুঁয়োপোকা। যারা অপয়া ভাদ্রমাসে অবিভক্ত চৈত্রের সিভিল লিবার্টি চায়, পতাকা চায়। শব্দকে শব্দের সমান্তরালে রেখে আমরা দেখি, বিজয় দে মাকু চালিয়ে যাচ্ছেন, অঙ্গুলিহীন এক তন্তুজীবী হওয়ার প্রত্যাশায়! কারণ সে জানে তার হাতে বোণা ধান একদিন গান হবে! যেন পাঁচ দশক ধরে এক অনন্ত খুকরি নিয়ে তিস্তা ও করলার পাড়ে মানবসংসারের সকল স্থাবর-অস্থাবর ঘন্টাধ্বনি শিকারের জন্য ওৎ পেতে বসে আছেন এক আদি অস্ত্রাল অক্ষরনিষাদ। বিজয় দে'র কবিতাগুলো কিছু কপট ফুলের সরলবর্গীয় বাগানও হয়ে ওঠে কখনও কখনও। যে বাগান আগ্নেয়াস্ত্রে ভরা, মেঘে ঢাকা তারার মতো। অথবা যে বাগানের প্রতিটি শিশুফুল একদিন সবাই মিলে হয়ে যাবে লাতিন আমেরিকার বৃন্দগান। আশ্চর্য আইফেল টাওয়ারের মিনারের গান। দেশের বাড়ির পান-বরোজের গান। কোলাহলহীন শব্দের গ্যালাক্সি হয়ে যাবে। সেই গ্যালাক্সিতে সংসার পাতবেন এক আদি শব্দরাখাল। যেন বিজয় নির্মাণ করছেন হাসিকান্না মিশ্রিত বাংলা ভাষার নতুন অক্ষর পথ। যারা ওর লেখা জান দিয়ে পড়েছেন, প্রাণ দিয়ে পড়েছেন, তারা হয়তো আধুনিকোত্তর সেই অক্ষরপথের সন্ধান পেয়ে গেছেন বা সেই ভার্চুয়ালিটিকে ছুঁতে চলেছেন। এও হতে পারে কবিতা-শহিদ হতে চলেছেন। আমার মতো আকম্মা ভাষা-ঢেঁকিরা সে শব্দবহ্নির উত্তাপ আঁচ করতে পারব না। কবিতার ফিলোসফিক্যাল মাইলফলক নয়, বিজয় দে গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে শব্দের দার্শনিক মেহেফিল খুঁজে চলেছেন। সেই মেহেফিলে তিনিই মহামতি লেনিন।
বিজয়ের কবিতার পারমাণবিক স্ফিয়ার খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিজয়ের কবিতার ভায়োলেন্স গুলো এত আপাত-নির্বিকার যে তারা যেন ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। এগুলো আমরা দেখেছি বোম্বে টকিতে, এবং সবশেষে সমগ্র মধুবালা কেবিনে। ‘একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর বালিকারা এখানে হাঁস হয়ে আসে...’ কীসের ইংগিত? কিংবা, ‘পুঁটুলি-ভরা উঠোন নিয়ে এক্খুনি যিনি দৌড়ে যাচ্ছেন, নাকি পালিয়ে যাচ্ছেন / তাকে আমার মা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে’ -- এসব পংক্তি বাঙালি মনন ও ঐতিহ্য-সনাতন জীবনবীক্খার অভিব্যাক্তি ছাড়া আর কী? বিজয় দে'র ৬৮তম জন্মদিনে আমরা একটি জন্মদিন-মুবারক বিজয়-স্মরণিকা বানিয়েছিলাম। তাতে আমি লিখেছিলাম, “বলিউডের সুউচ্চ সেরেস্তাদার ইন্সপেক্টর বিজয়ের মতোই এ বিজয়ও এখন বাংলা কবিতার সংসারে জলপাই স্যাংচুয়ারি থেকে উঠে আসা এক হ্দয় কাঁপানো অফ্ স্পিনার। ওঁর কবিতার সার্জারি তারাই করতে পারেন, যারা 'নিরূপায় ও নির্যাতিত'। কারণ, 'পার্বণ' নামের একটি কবিতায় বিজয় লিখেছিল, ‘দুর্গা হেঁটে গেল/ কয়েকটি হলুদ লেখার হাত খসে পড়লো/ লক্খী হেঁটে গেল/ কয়েকটি অজানা পূর্ণিমা যেন/ সরস্বতী হেঁটে গেল/ কয়েকটি নির্জন আমলকীর অপেক্খা/ শ্যামাসঙ্গীত হেঁটে গেল/ কয়েকজন রামপ্রসাদ খসে পড়লো’।”
বিজয় দে'র কবিতা আমি শুধু পড়িই না, রীতিমতো পাঠ করি। আমার কেন যেন মনে হয়, এই আন্তর্জাতিক মেজাজের কবি কখনও যেমন মেট্রোপলি থেকে পিঠ ভর্তি করে ইমপোর্টেড স্কচ নিয়ে এসে পাঁচশো মাইল দূরের তার স্বনির্মিত গ্রামের মাঠে সেই স্কচের সঙ্গে তার গ্রামীন দেবজানীর বিয়ে দেন, আবার কখনওবা, তার দেশের বাড়ির হোগলা বনের ছায়ায় বেড়ে ওঠা গাছপাকা পেঁপের ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে লিন্ডসে স্ট্রিটে অবৈতনিক জিম খোলেন।
বিজয় দে'র মাইকেল-পুরস্কারপ্রাপ্তিতে অনেকেই এখন নতুন উৎসাহে ওঁর কবিতা খুঁজে খুঁজে পড়ছেন বা তাঁর কবিতার আদি পাঠকেরা আগের চাইতে বেশি স্বস্তি পাচ্ছেন, এটা যথেষ্ট আনন্দের। এটা বুঝবার সময় বোধহয় এসে গেছে, যে বিজয়ের কবিতার ভুবন যতটা তার রক্তের মৃত্তিকার ভিতে, ততটাই তাঁর নিবিড় অনুভবী মনন ও চিন্তনের জলের শক্তির ভেতর। ওঁর সম্পর্কে আমার পুরানো হয়ে যাওয়া কথা হলো, বাংলা কবিতার নক্ষত্রালোকে প্রবহমান কোন দেবতার বরে এরকম সর্বদা-জাগ্রত কবিতার রকষ্টার জন্মান, কে জানে!
ব্যপারটা হলো, এখন আরোও নিবিড়ভাবে আমাদের এখন বিজয়ের কবিতার নিয়ত পরিবর্তনশীল জার্সি চিনতে হবে! কোন কবিতা কখন যে কি পোশাকে মঞ্চে আসবে, বলা কঠিন। বেশ কঠিন! আনপ্রেডিক্টেবল! হ্যাঁ, আরেকটি কথা, বিজয়ের কবিতা দুরূহ নয়, একটু দুর্গম!
বিজয় দে'র কবিতা নিয়ে এর আগে কিঞ্চিৎ লিখেছি। সেগুলো সবই খসড়া বলে পরে মনে হয়েছে। আজ এই লেখাটিকেও সেরকমই মনে হচ্ছে। অতএব অনতিবিলম্বেই আমাদের আরও বিশদে লিখতে হবে!
সক্রেটিস সংবর্ধনায় পঠিত
Comments
Post a Comment